ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাবাহিত ভাইরাল সংক্রমণ। এডিস মশার কামড়ে মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই রোগে কেউ তখনই আক্রান্ত হন, যখন মশা সংক্রমিত কোনো ব্যক্তিকে কামড়ে তারপর ভাইরাস বহন করার সময় একজন অ-সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড় দেয়।
Dengue কি ?
ডেঙ্গু একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ।এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়।
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ
-সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে।
-ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ শরীরে ব্যথা। সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হতে পারে। সঙ্গে চামড়ায় লালচে দাগ বা র্যাশ থাকতে পারে।
-শরীর ঠান্ডা হচ্ছে মনে হতে পারে। ক্ষুধা কমে যাওয়া, শরীর ম্যাজম্যাজ করার লক্ষণও দেখা দিতে পারে।
সিভিয়ার ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তীব্র পেট ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, রক্তবমি, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ, ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ, শ্বাসকার্য কঠিন বা দ্রুত হওয়া, শরীর ঠান্ডা অনুভব বা ঘাম হওয়া, দ্রুত নাড়ি স্পন্দন এবং ঘুম ঘুম ভাব, চেতনা হারানো।
-ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম থেকে মানবদেহে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাল্স রেট অনেকটা বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ খুব কমে যায়। শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস খুব দ্রুত চলে। রোগী অস্থির হয়ে ওঠেন। তখন সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত।
ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা
-ডেঙ্গু হলে ওষুধ হিসেবে শুধু প্যারাসিটামল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। অনেকে না জেনে শরীরের বিভিন্ন অংশের তীব্র ব্যথা কমানোর জন্য ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে বিপদ ঘটতে পারে বলে সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা। কারণ, ব্যথানাশক ওষুধ শরীরে রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে, যা ডেকে আনতে পারে মৃত্যু।
-ডেঙ্গু হলে চিকিৎসকরা বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। যেমন- ভাতের মাড়, স্যালাইন, ডাবের পানি, স্যুপ, ফলের রস, লেবুর পানি ইত্যাদি। তরল খাবার ৯০ শতাংশ কমায় ডেঙ্গুর তীব্রতা। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার ডাল, ডিম, মুরগির মাংস, ছোট মাছের ঝোল বেশি করে রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়।
-ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়। তাই প্লাটিলেট বাড়ে এমন খাবার খেতে হবে। যেমন- সাইট্রাস ফল, কাঠবাদাম, দই, সূর্যমুখী বীজ, গ্রিন টি, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলি, পালংশাক, আদা, রসুন ও হলুদ।
-পেয়ারার শরবত পান করা যেতে পারে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই পানীয়টি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে ডেঙ্গু সংক্রমণ উপশম করবে।
-রক্তের প্লাটিলেট বাড়াতে নিম পাতার রস ভালো কাজ করে। এটি শ্বেত রক্তকনিকার সংখ্যাও বৃদ্ধি করে। নিম পাতার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর গুণও আছে।
শিশুদের ডেঙ্গু
শিশুরা আক্রান্ত হয় বেশি, জটিলতার হারও বেশি। তাই এ সময় শিশুদের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।
ভাইরাস শরীরে প্রবেশের সাধারণত চার থেকে সাত দিনের মধ্যে (৩ থেকে ১৪ দিন) ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ দেখা দেয়। প্রথম এক থেকে পাঁচ দিনÑহঠাৎ উচ্চ মাত্রার জ্বর (প্রায় ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট), সঙ্গে বমি ভাব, বমি, র্যাশ (উপসর্গের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে ত্বকে লাল ফুসকুড়ি অথবা অসুখের চার থেকে সাত দিনের মধ্যে হামের মতো লাল বিন্দু), হাড়ের জোড়ায় গাঁটে ও মাংসপেশিতে প্রবল ব্যথা হয়।
কিছু লক্ষণ ‘বিপজ্জনক চিহ্ন’ হিসেবে স্বীকৃত, সেগুলো হলোÑপেটের ব্যথা, অনবরত বমি, শরীরে পানি জমা, নাক, মাড়ি থেকে রক্তপাত, অতিরিক্ত দুর্বলতা, অস্থিরতা, লিভার স্ফীতিÑ২ সেন্টিমিটারের বেশি, ল্যাব পরীক্ষায়Ñরক্তে হিমাটোক্রিটের মান বৃদ্ধি, অণুচক্রিকা দ্রুত কমতে থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরের পাঁচ থেকে সাত দিন সময়কালে ‘মারাত্মক ডেঙ্গুর’ চিহ্নাদি দেখা দিতে পারে। যেমন ডেঙ্গু শক সিনড্রোম, শরীরে পানি জমা, নাড়ি দুর্বল, শীতল শরীর (তাপমাত্রা ৯৬.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটের কম), রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কম, অতিরিক্ত রক্তপাত, লিভার: এএসটি বা এএলটির মান এক হাজার বা বেশি, অচৈতন্য অবস্থা, হার্ট ও অন্য অঙ্গে রোগের লক্ষণ প্রভৃতি।
শিশুর চিকিৎসা ও প্রতিকার:
শিশুর জ্বরের সাধারণ উপসর্গকে শিশুর ‘অন্যান্য মৌসুমি জ্বরের’ লক্ষণ মনে করে বসে না থেকে জ্বর হওয়ার প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। অন্যথায় ‘বিপজ্জনক চিহ্ন’ বা ‘মারাত্মক ডেঙ্গুর’ চিহ্নাদি নিয়ে শিশুর সংকটজনক অবস্থা হতে পারে।
জ্বর পুরোপুরি চলে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর রোগী বেশি অসুস্থতা অনুভব করলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত। প্রয়োজনে রক্ত বা প্লাজমা সঞ্চালন এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের ত্বরিত বিশেষ চিকিৎসা নিতে হবে।
পর্যাপ্ত চিকিৎসায় ডেঙ্গু আক্রান্তে মৃত্যুহার ১ শতাংশ। কিন্তু শক দেখা দিলে, তা বেড়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকলাবস্থা (পিএমআইসি), চিকিৎসাকালীন ওভারহাইড্রেশন, ডায়াবেটিস ও অ্যাজমার মতো দীর্ঘমেয়াদি অসুখে ভোগা শিশুর ক্ষেত্রে ডেঙ্গু বেশি প্রাণঘাতী।
রোগ জটিলতা থেকে পরবর্তী সময়ে চুল পড়ে যাওয়া, ডিপ্রেশন, ট্রান্সভার্স মাইলাইটিস ও গিয়েন বারির মতো স্নায়ুরোগের ঝুঁকি থাকে।
এখন বৈশ্বিকভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় এডিস মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা। শিশুকে ফুল শার্ট, ফুল প্যান্ট ও মোজা পরানো। দিনেও মশারি টানিয়ে ঘুমানো উচিত।
সচেতনতা
এডিস মশা চেনাঃ
একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই যে কেউ ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশাকে খালি চোখেই চিনতে পারবেন। মাঝারি আকারের সাদা-কালো ডোরাকাটা এই মশার শুঁড় থাকে লোমযুক্ত। এদের মাথার পেছনের উপরের দিকেও একটি সাদা দাগ থাকে, তাই সাধারণ মশা থেকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়।
কাল-থেকে সন্ধ্যা, সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত সময়ে এডিস মশার কামড় দেয়। সাধারণত সকালের প্রথম দিকে এবং সন্ধ্যার ঠিক কিছুটা আগে এডিস মশা তৎপর থাকে। অনেকেই আবার ভাবেন, এডিস মশা বোধহয় শুধু পায়েই কামড়ায়। এটাও এক ধরনের ভুল ধারণা। পায়ের অংশ শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় উন্মুক্ত থাকে বলে, ওই জায়গাকেই এরা কামড়ানোর জন্য বেছে নেয়।
করণীয়ঃ
-ডেঙ্গু একটি মশা-বাহিত রোগ। তাই মশার কামড়ের হাত থেকে নিজেকে এবং আপনার পরিবার কে বাঁচান।
বাড়ির চারপাশে জল জমতে দেবেন না। জমা জলে মশারা বংশবিস্তার করে। জল জমতে না দিয়ে মশার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সপ্তাহে অন্তত একবার জল জমতে পারে এমন জায়গা পর্যবেক্ষণ করুন। এবং গাছের টব, ফুলদানি, পরে থাকা গাড়ির টায়ারের জমে থাকা জল ফেলে দিন।
-শরীর ঢাকা জামা কাপড় যেমন লম্বা-হাতা শার্ট, লম্বা প্যান্ট, মোজা এবং জুতা পরুন।
ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। এই সময় অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন।
-রাতে শোবার সময় মশারী ব্যবহার করুন।
-মশা নিরোধক কেমিক্যাল যেমন পারমেথ্রিন ব্যবহার করুন।
উপসংহারঃ
ডেঙ্গু জ্বর একটি সাধারণ রোগ। কিন্তু অবহেলা করলে এই রোগ মারাত্মক হতে পারে। শহরাঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি। তাই নগরবাসীকে আরেকটু সজাগ ও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে যাদের ডেঙ্গু হয়েছে তাদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। দ্বিতীয় ডেঙ্গু সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং ভালো থাকুন।